শরীফ শিক্ষা কমিশন আন্দোলন; ছবি : সংগৃহীত।
১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের এক গৌরবোজ্জল ইতিহাস। দেশ ও জাতির যেকোন প্রয়োজনে আত্মদানের ঐতিহ্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে করেছে মহিমান্বিত। অনুরূপ শিক্ষা কমিশন আন্দোলনের বীরত্বগাথা ইতিহাসে বাংলার ছাত্রসমাজ ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। শুধুমাত্র শিক্ষা স্তরে অধিকার আদায়ের দাবিতে রক্তক্ষয়ী এমন আন্দোলন এ দেশে আর কখনও হয়নি।
১৯৬২ সালটি ছিল আন্দোলনমুখর এক অগ্নিগর্ভ বছর। ১৯৬১ সালের ডিসেম্বর মাসেই ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ এবং খোকা রায় এর মধ্যে এক সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন একত্রে স্বৈরসাশক আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবে এবং সেটা ১৯৬২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে শহীদ দিবসেই এই আন্দোলন কর্মসূচীর সূচনা হবে।
কিন্তু ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি আইয়ুব সরকার পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে করাচিতে গ্রেফতার করে। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হলে আন্দোলন কর্মসূচীর নির্ধারিত তারিখ পর্যন্ত কাল বিলম্ব না করেই সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি ও চার বছরের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার ছাত্রসমাজ আন্দোলনের দূর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলনের মূল সংগঠক ছিল ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন। স্বৈর শাসক আইয়ুব সরকারের তীব্র দমননীতি মোকাবেলা করে বাংলার ছাত্র সমাজ আন্দোলন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। সামরিকতন্ত্রের দমন পীড়নের কারনে আন্দোলন প্রক্রিয়া কিছুটা স্তিমিত হলেও এপ্রিল থেকে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র ইস্যুতে আবার ছাত্রলীগ বাংলার ছাত্রসমাজকে নিয়ে মাঠে নামে।
আন্দোলনের একপর্যায়ে পাকিস্তান স্বৈরশাসক ‘ফিল্ড মার্শাল’ আইয়ুব খান পিছু হটতে বাধ্য হন। ১৯৬২ সালের ৮ জুন পাকিস্তানে দির্ঘ ৪ বছরের স্থায়ী সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়। বিরোধী দলগুলোর মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও একটি সংবিধান জারি, পরোক্ষ ভোটে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের মাধ্যমে আইয়ুব খানের বেসামরিক শাসন সুদৃঢ় করা হয়।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯৬২ সালের আগস্ট মাস থেকে বাংলার ছাত্রসমাজ আবার ‘শরীফ শিক্ষা কমিশন’ এর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন শুরু করে। দেশের ইতিহাসে এটিই একমাত্র ছাত্র আন্দোলন, যা ছাত্র সংগঠনগুলোর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সংগঠিত হয় নি। এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ঢাকা কলেজ থেকে। আইয়ুব সরকার ‘শরীফ শিক্ষা কমিশন’ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে, বিশেষত তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অতিরিক্ত ইংরেজি চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে প্রথমে ঢাকা কলেজে এ আন্দোলনের সূচনা হয়। পরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কলেজ ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এর প্রতিবাদে সভা সমাবেশ, মিছিল, মিটিং করতে থাকে। আন্দোলনরত ছাত্রদের মধ্যে প্রথমে ‘ডিগ্রি স্টুডেন্টস ফোরাম’ নামে এবং পরে ‘ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফোরাম’ নামে দলমতের ঊর্ধ্বে সাধারণ ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম গড়ে ওঠে। কলেজ ছাত্ররা এই আন্দোলনের সূত্রপাত করলেও, পরে ১৯৬২ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত আমতলায় এক ছাত্র সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজও এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে শুরু করে।
ছাত্রলীগ এই আন্দোলনের বিস্তৃৃতি এবং তীব্রতা উপলব্ধি করলে ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দদের সাথে নিয়ে শিক্ষার দাবিতে আন্দোলনকে আরও সুসংগঠিত এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে আনার লক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়। তখনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’।
ছাত্রনেতারা বিচ্ছিন্নভাবে শুধুমাত্র তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স বাতিল অথবা ইংরেজির বোঝা কমানোর দাবি বাদ দিয়ে মূল দাবি হিসেবে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিটিকে সামনে আনেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর আইয়ুব খান সরকার শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে তার এক সময়ের শিক্ষক এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব এসএম শরিফকে চেয়ারম্যান করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট তার অন্তর্র্বতীকালীন রিপোর্ট পেশ করেন। দীর্ঘদিন পর ১৯৬২ সালে চূড়ান্ত রিপোর্ট ছাপিয়ে গ্রন্থাকারে গ্রকাশ করা হয়।
সম্পূর্ণ গণবিরোধী এবং প্রতিক্রিয়াশীল এই রিপোর্ট কেবল শিক্ষা সংকোচনের দলিলই ছিল না, এই রিপোর্টের অনেক সুপারিশ বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্বে আঘাত হেনেছিল। রিপোর্টের মূল কয়েকটি সুপারিশ ও অভিমতের মধ্যে ছিল-
১) শিক্ষা নাগরিকের জন্মগত অধিকার নয়। শিক্ষা একটি উত্তম ব্যয়বহুল বিনিয়োগ।
২) অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা অবাস্তব এবং রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়।
৩) ষষ্ঠ থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক।
৪) ডিগ্রি কোর্স হবে তিন বছর মেয়াদি।
৫) সমগ্র পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বোধগম্যতার জন্য উর্দুকে জনগণের ভাষায় পরিণত করা। কোরআনের ভাষা আরবি লিপিতে উর্দুর মতো বাংলাও লেখা যেতে পারে। তবে চূড়ান্ত সুপারিশে বলা হয়, বাংলা ও উর্দু লিপি সংস্কার করে রোমান হরফে বাংলা এবং উর্দু লেখা।
শরীফ কমিশনের এসব গণবিরোধী এবং চরম প্রতিক্রিয়াশীল সুপারিশ বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ এবং শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের মধ্যে তীব্র ঘৃণার সঞ্চার করে। ছাত্রসমাজ শরীফ কমিশন বাতিলের দাবি উত্থাপন করলে তা সামগ্রিকভাবে জনগণের বিপুল সমর্থন পায়। আন্দোলন সংগঠিত ও মিলিটেন্ট রূপ নেয়। ১৫ আগস্ট থেকে আন্দোলনে বাঁধ ভাঙা জোয়ারের সৃষ্টি হয়। একের পর এক ধর্মঘট সমাবেশের কর্মসূচি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেমন অচলাবস্থার সৃষ্টি করে, তেমনি ক্রমেই এই আন্দোলনের শ্রমজীবী ও পেশাজীবী বিভিন্ন স্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূত অংশগ্রহণ শিক্ষা আন্দোলনকে ‘গণ আন্দোলনে’ রূপান্তরিত করে। ১০ সেপ্টেম্বর, বাঙ্গালী ছাত্রনেতারা সচিবালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচীর ঘোষণা দিলে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১০ সেপ্টেম্বরের কর্মসূচি বাতিলর করে। তবে তার পরিবর্তে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে। ১০ সেপ্টেম্বর সরকার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। সরকারের প্রত্যাশা ছিল সোহরাওয়ার্দী মুক্ত হলে আন্দোলন স্তবির হয়ে পড়বে। কিন্তু এই আশা দুরাশায় পরিণত হয় আইয়ুব সরকারের।
১৭ সেপ্টেম্বর সারাদেশে অভূতপূর্ব হরতাল ও ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। রাজধানী ঢাকার রাজপথে নেমে আসে লক্ষ লক্ষ মানুষ। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশকে সহায়তা করার জন্য ইপিআর ও সেনাবাহিনী নামায়। ছাত্র জনতার বিশাল জঙ্গি মিছিল হাইকোর্ট পার হয়ে আবদুল গণি রোডে (সচিবালয়ের কাছে) প্রবেশ করতেই মিছিলের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ করা হয়। পুলিশের গুলিতে তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হন বাবুল এবং বাস কন্ডাক্টর মোস্তফা। গৃহভৃত্য ওয়াজিউল্লাহ গুরুতর আহত হয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ১৭ সেপ্টেম্বর কার্যত ছাত্রসমাজের অভ্যুত্থানে পরিণত হয়।
ঐ দিনের বিক্ষোভ মিছিলে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের উপস্থিতিই বেশি হয়। ১৭ সেপ্টেম্বরের আন্দোলনকারিদের বিরুদ্ধে অমানবিক দমন পীড়ন চালানো হয়। সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বাংলার ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে বাঙ্গালী আন্দোলন অব্যাহত রাখে। একপর্যায়ে সরকার নমনীয় হতে বাধ্য হয়। ছাত্রসমাজ ও আন্দোলনকারী জনগণের পক্ষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর গোলাম ফারুকের সাথে আলোচনায় বসেন।
২৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বপ্রথম পল্টন ময়দানে জনসভা আহ্বান করে। ঐ জনসভা থেকে সরকারের প্রতি ‘চরমপত্র’ দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে গভর্নর গোলাম ফারুকের কয়েক দফা বৈঠক হয়। ছাত্রসমাজের এই ‘চরমপত্র’ দেওয়ার তিন দিন পর, সরকার শরীফ কমিশন রিপোর্ট স্থগিত ঘোষণা করে। ডিগ্রি কোর্সের ছাত্রদের, যাদের দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছিল এবং তৃতীয় বর্ষে উঠেছিল তাদের বিনা পরীক্ষায় সবাইকে পাস ঘোষণা করা হয়। গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তি দেওয়া হয়।
অবশেষে বিজয়ের মধ্যদিয়ে ৬২ সালের গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৯৬৩ সাল থেকে ছাত্রসমাজ ১৭ সেপ্টেম্বর দিনটিকে প্রতিবছর ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। স্বাধীনতার আগে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে শিক্ষা দিবস পালিত হতো। স্বাধীনতার পর দিনটি ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে।