সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ ঢাকা, বাংলাদেশ
সংবাদ

ভাষাশহীদ দিবসের ইতিকথা

ভাষাশহীদ দিবসের ইতিকথা

ফাইল ছবি: অধ্যাপক শেখর কুমার সান্যাল।

ফিক্সনিউজ: কিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল পাকিস্তান জন্মের আগে থেকেই। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান ঘোষণা করলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। দৈনিক ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় ২২ এবং ২৯ জুন দুই পর্বে ‘বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব’ প্রবন্ধে রাজশাহীর আব্দুল হক প্রথম উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতা করেন এবং উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার দাবি জানান। ৩০ জুন তিনি ‘আজাদ’ পত্রিকায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামে আরও একটি প্রবন্ধ লেখেন। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দীন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দিলেন। ২৯ জুলাই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘আজাদ’ পত্রিকায় লিখলেন—বাংলাই হওয়া উচিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তবে দুটি রাষ্ট্রভাষা হলে উর্দুর কথা বিবেচনা করা যায়। ৩ আগস্ট ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘কমরেড’ পত্রিকায় ‘দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেম অব পাকিস্তান’ নিবন্ধে বলেন, ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাংলাভাষী অংশে যদি বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা রাষ্ট্রভাষা হয়, তাহলে সেই স্বাধীনতা হবে পরাধীনতার নামান্তর।’ এ সবই ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের আগের ঘটনা।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত চলতে থাকে। ১৯৪৮ সালে করাচিতে গণপরিষদের অধিবেশনে জিন্নাহ সভাপতিত্ব করেছেন। পার্লামেন্টে একটি বিবিধ প্রস্তাব এসেছে, ‘গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজির সঙ্গে উর্দুও বিবেচিত হবে।’ কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ তারিখে একটি ছোট্ট সংশোধনী নোটিশ দিলেন। দুই দিন পর ২৩ ফেব্রুয়ারি ফ্লোর পেয়ে বললেন, ইংরেজি শব্দের পর ‘অথবা বাংলা’ শব্দ দুটি যুক্ত করা হোক। এর পক্ষে জোরালো যুক্তি দিলেন। দেশের ছয় কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে চার কোটি ৪০ লাখের মুখের ভাষাকে প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে গণ্য না করে তাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান একে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রস্তাব বলে উপেক্ষা করে বললেন, পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র। তাই মুসলিম জাতির ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা ভাষাভাষী ছিলেন ৫৬ শতাংশ আর উর্দু মাত্র ৩ শতাংশ। খোদ পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশ ছিলেন উর্দুভাষী।

বাংলা ভাষার ঐতিহ্য দুই হাজার বছরের প্রাচীন। উর্দু ভাষার উদ্ভব শ-পাঁচেক বছর আগে। ভারতে মুসলিম শাসক ও তাদের সহযোগীদের আগমনের ফলে দিল্লি-মিরাট অঞ্চলে প্রচলিত আঞ্চলিক খাড়ি বোলি কথ্য ভাষার সঙ্গে প্রায় দুই শতক (১২০০-১৪০০) ধরে ফারসি শব্দের মিশ্রণের ফলে একটি সংকর ভাষার জন্ম হয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী সৈনিকদের যোগাযোগের ভাষা হিসেবে মোগল সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) শাসনামল থেকে মিশ্র ভাষাটি ব্যবহৃত হতে থাকে। তখন এটি ‘হিন্দভি’ এবং ‘হিন্দুস্তানি’ নামে প্রচলিত ছিল। তুর্কি ভাষায় ‘ওর্দু’ মানে সেনাশিবির। মোগল সম্রাট শাহজাহানের (১৬২৮-১৬৫৮) সেনানিবাসের নাম ছিল ‘উর্দু-এ-মুআল্লা’। সৈনিকদের পোশাককে বলা হতো ‘উর্দি’। এখানে বিভিন্ন এলাকার সৈন্যরা ফারসি-হিন্দুস্তানি মিশ্রিত ভাষায় কথা বলত। শাহজাহান তার সেনানিবাসের নামে এ ভাষার নামকরণ করেন ‘উর্দু’।

খাড়ি বোলি ভাষার একটি রূপ ধীরে ধীরে ফারসি ও আরবি ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ ধার করলে উর্দু নামে এক সাহিত্যিক ভাষার উদ্ভব ঘটে। ‘উর্দু’ শব্দটি সাহিত্যে সর্বপ্রথম কবি গোলাম হামাদানি মুশফি ১৭৮০ সালের দিকে হিন্দুস্তানি ভাষার জন্য ব্যবহার করেছিলেন। পরে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অনেক সাহিত্যিক এই ভাষায় লিখেছেন। আজকের যে ভাষাটি উর্দু নামে পরিচিত, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত সেই ভাষাটি যুগপৎ হিন্দি, হিন্দভি, হিন্দুস্তানি ভাষা নামে পরিচিত ছিল। বলা হয়ে থাকে উর্দু হরফে ফারসি, ধ্বনিতে হিন্দি, সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া। উর্দু কীভাবে মুসলিম জাতির ভাষা হয়!

তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সংগত কারণেই বলেছিলেন, তা হলে তো আরবিকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম। নিজেদের ভাষা ছেড়ে কেউই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করেনি। পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা বলে কথিত কবি আল্লামা ইকবালেরও উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে মাত্র ‘শিকওয়া’ ও ‘জওয়াব-ই-শিকওয়া’ উর্দুতে। বাকি সব ফারসিতে।

পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদে ৭৯ জন সদস্যের মধ্যে ৪৪ জন পূর্ব বাংলার হওয়া সত্ত্বেও দুঃখজনকভাবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।

১৯ মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এলেন। প্রথমে ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় বললেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’। অনেকেই হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল ‘মানি না’। এরপর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে জিন্নাহ আবার ঘোষণা করেন, ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ ‘না না না’ জিন্নাহকে কয়েক মিনিটের জন্য স্তব্ধ করে দেয়। এক শ্রেণির বাঙালি বুদ্ধিজীবীও সেদিন জিন্নাহর কথায় সায় দিয়েছিলেন। প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠল।

 

ষোড়শ শতকের সাধক কবি সৈয়দ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৮) ‘ওফাতে রসুল’ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন–

‘যারে যেই ভাষে প্রভু করিছে সৃজন

সেই ভাষ তাহার অমূল্য সেই ধন।’

মধ্যযুগের আর একজন বিখ্যাত কবি সন্দীপের আব্দুল হাকিম (১৬২০-১৬৯০) ‘নূরনামা’য় লিখেছিলেন—

‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।

সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জান।।

দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।

নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।।’

 

১৯৫১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সুলতান মোহাম্মদ শাহ আগা খান করাচিতে বললেন, ‘যে ভাষাটি কারোই নয়, যে ভাষার সঙ্গে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বন্ধন নেই, তা কেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে?’

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ক্রমে জোরদার হতে থাকে। বাঙালিরা কিন্তু উর্দুর বিরোধিতা করেনি। তাদের দাবি, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। এটা এমন কিছু বড় দাবি ছিল না; অথচ এই দাবি মানাতে বাঙালিকে অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশে একাধিক রাষ্ট্রভাষা আছে। সে সময় মিছিলে স্লোগান দেওয়া হতো ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দুর সাথে বিবাদ নাই’।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গাজীউল হকের সভাপতিত্বে এক সভার সিদ্ধান্তে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করে। পুলিশ গুলি চালালে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র ও নিরীহ মানুষ শহীদ হন। কাকতালীয়ভাবে পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম সরকারি ভাষা করার জন্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনী নোটিশের তারিখও ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসের ছাত্র, উত্তরকালের লব্ধপ্রতিষ্ঠিত লেখক-সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী আহত এক ভাষাসৈনিকের শয্যাপাশে বসে লিখলেন কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। প্রথমে আব্দুল লতিফ গানটিতে সুর দেন। পরে বর্তমানে প্রচলিত আবেগমথিত কান্নাঝরা সুরটি দেন আলতাফ মাহমুদ। এখনো বিশ্বব্যাপী বাঙালি এই সুরেই ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’র প্রভাতফেরিতে এই গান গেয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

এক সময় বাংলা হরফও পরিবর্তন করার চেষ্টা হলে তা প্রতিহত করা হয়। আব্দুল লতিফ নিজে লিখে সুর দিয়ে গেয়েছিলেন ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি উর্দুর সঙ্গে বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়।

১৯৫৩ সাল থেকে কিংশুক রক্তরাগে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ দিবস রূপে পালিত হয়ে আসছে; কখনো রাষ্ট্রীয় বাধা উপেক্ষা করে আবার কখনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নিয়ে। একাত্তর বছর ধরে একুশের মহিমা জীবন্ত সত্তা হয়ে আছে। একুশের চেতনা থেকে আমরা কী পেয়েছি, বলে শেষ করা যাবে না। একুশের আগে আমাদের ভাষা ছিল, মাতৃভাষা ছিল না। ভূমি ছিল, মাতৃভূমি ছিল না। দেশ ছিল, স্বদেশ ছিল না। একুশ আমাদের বারবার বিস্মৃত জাতিসত্তা ফিরিয়ে দিয়েছে। বায়ান্ন থেকে একাত্তর—২০ বছরে ধাপে ধাপে যাত্রাপথে আমাদের দিশারি একুশের চেতনা। শহীদ মিনার থেকে ২০ বছরে আমরা পৌঁছে গেলাম ২০ মাইল দূরে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে। একুশ না হলে আমরা পাঞ্জাবি প্রভুদের পদলেহনকারী গোলামে পরিণত হতাম। একুশ আমাদের সে গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছে। একুশেই নিহিত ছিল স্বাধীনতার বীজ।

মোদের গরব, মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা!

লেখক: প্রাবন্ধিক

এই কুইজে


- জন
অংশগ্রহণ করেছেন
আপনিও রেজিষ্ট্রেশন করুন


ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধু

ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধু

১৪ আগস্ট ২০২০

আজ আপনার জন্য আর কোন পরীক্ষা নেই!

শিরোনাম:
   নিজের সন্তানের প্রতি বাবার লেখা খোলা চিঠি!        ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিচারের ঘটনায় উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র        ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পদত্যাগ।        ইমরান খানের প্রশ্ন” কে ছিলো প্রকৃত বিশ্বাসঘাতক ? ইয়াহিয়া না’কি শেখ মুজিব।        চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সেনা অফিসারের অভ্যুত্থান, নাকি হত্যাকাণ্ড?        র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) নতুন দায়িত্বে ব্যারিস্টার মো. হারুন অর রশীদ।        কৃষি শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি        এপ্রিল মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ২০৪ কোটি ডলার        তীব্র তাপপ্রবাহে ডিহাইড্রেশন, হিট স্ট্রোক, মাথা ধরা, পেটের অসুখের প্রতিকার এই চার খাবারে        গাজীপুরে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে চারজন আহত।        হেফাজতে ইসলামের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের মুক্তি        দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার পরামর্শ        চাঁদার না দেয়ায় প্রবাসী ব্যাবসায়ী ও পরিবারের উপর হামলার অভিযোগ        শরীরে পানির অভাবে বাড়তে পারে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি।        টন বলতে এসির সাইজ বা ওজনকে বোঝায় না।